বিএনপির আন্দোলনে নতুন যাত্রা

নয়াপল্টনের সমাবেশে এক দফা এক দাবির ঘোষণা কাল

  বিশেষ প্রতিনিধি    11-07-2023    102
বিএনপির আন্দোলনে নতুন যাত্রা

প্রবাদে রয়েছে ‘ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়’। ২০১৮ সালের রাতের ভোটের অভিজ্ঞতার আলোকে বিএনপি আর শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে যাবে না। দীর্ঘ এক বছর উপজেলা-জেলা-বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের সক্রিয় করে প্রবল শক্তি সঞ্চয় করে সরকারের পতন ও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে এবার চূড়ান্ত পর্যায়ের রাজপথে আন্দোলনে নামছে মাঠের প্রধান বিরোধী দলখ্যাত দলটি।

এক দফার এই আন্দোলনে সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে ডান-বাম-মধ্যপন্থী সমমনা দলগুলো। সবার মুখে এক আওয়াজ হবে ‘শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন’। আগামীকাল বুধবার রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ থেকে এক দফা দাবি (ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেয়া, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন) ঘোষণা করবে দলটি। একইসঙ্গে এই দাবি আদায়ে চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচিও ঘোষণা করা হবে।

নতুন এই কর্মসূচিকে ‘আন্দোলনের নতুন যাত্রা’ হিসেবেও উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বুধবার ঢাকায় বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর যে সমাবেশের কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে, সেদিন থেকে আন্দোলনের ‘নতুন যাত্রা’ শুরু হবে। সেখান থেকেই সরকার পরিবর্তনের চূড়ান্ত পর্যায়ের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। তিনি বলেন, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাহেব (তারেক রহমান) সিদ্ধান্ত দিয়েছেন এবং আমাদের যে যুগপৎ আন্দোলন হচ্ছে সেই আন্দোলনে সম্পৃক্ত সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো, জোটগুলো আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, ১২ তারিখে আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে আমাদের নতুন গণতন্ত্রের জন্যে যে যাত্রা, একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্যে নতুন যে আন্দোলনের যাত্রা তার ঘোষণা আমরা দেব।

সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেয়া, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা, তাদের মাধ্যমে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবিতে গতবছরের অক্টোবর থেকে নতুন ধারায় আন্দোলন শুরু করেছে বিএনপি। সারাদেশের ইউনিয়ন, থানা/উপজেলা, জেলার পর বিভাগীয় পর্যায়ে ব্যাপক জনসমাগম ঘটিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেছে দলটি। ধারাবাহিকভাবে একের পর এক কর্মসূচিতে বেড়েছে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততাও। একইসঙ্গে সরকার পতনের এই আন্দোলনে অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে সাথে নিয়ে গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে যুগপৎ আন্দোলন। যেখানে ৩৬টি রাজনৈতিক দল পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করেছে। তাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই নতুন নতুন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থেকেছে বিএনপি। চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণার আগেও বিগত কয়েকদিনে গণতন্ত্র মঞ্চ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, বাংলাদেশ লেবার পার্টিসহ সকল দলের সঙ্গেই বৈঠক করেছেন বিএনপি নেতারা।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দল বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছে। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছেন। অন্যদিকে আজ ঢাকায় আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দল। বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার বিষয়ক মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া ১১ থেকে ১৪ জুলাই সফরকালে মার্কিন প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ব্যুরোর জন্য মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এবং এশিয়া বিষয়ক ব্যুরোর উপ-সহকারী প্রশাসক, ইউএসএআইডি অঞ্জলি কৌর প্রতিনিধি দলে থাকবেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নির্বাচন বিষয়ক ৬ সদস্যের তথ্যানুসন্ধানী টিমের ঢাকায় অবস্থান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া ও সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে নিজেদের শক্ত অবস্থান, জনসমর্থন, মানুষের সরকারবিরোধী মনোভাব তাদের সামনে তুলে ধরতে চায় বিএনপি।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, বিএনপি কখনোই বিশ্বাস করে না যে, বিদেশী কোন শক্তি এসে আমাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। আমরা বিশ্বাস করি জনগণের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারকে বিদায় নিতে হবে। তিনি বলেন, সরকার বিদেশীদের কাছে নালিশ করে এবং বিভিন্ন সময় বলেছে যে, বিএনপির জনসমর্থন নেই। কালকের সমাবেশের মাধ্যমে আমরা আবারো দেখিয়ে দিতে চাই দেশের বিপুল সংখ্যক জনগণ এই সরকারকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী এক নেতা বলেন, এখন যেহেতু ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় আছে। আবার মার্কিন প্রতিনিধি দলও ঢাকায় আসছে। এই সময়ে একটি বড় ধরণের শোডাউনের মাধ্যমে সরকারবিরোধী আন্দোলনে যে দেশের মানুষ স্বত:স্ফূর্তভাবে রাস্তায় নামছে সেটি দেখাতে চাই।

এলক্ষ্যে আগামীকালকের সমাবেশকে সফল করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা। ইতোমধ্যে এই সমাবেশের জন্য পুলিশের অনুমতি পেয়েছে বিএনপি। তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও জোটও এদিন পৃথকভাবে রাজধানীতে বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচিতে এক দফার ঘোষণা দেবে।

ঢাকার এই সমাবেশটিতে ব্যাপক লোক সমাগম ঘটাতে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নির্দেশনা দিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এলক্ষ্যে ঢাকা মহানগর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলো পৃথকভাবে প্রস্তুতি সভা করেছে। এসব সভা থেকে ১২ জুলাইয়ের সমাবেশে জনতার জন¯্রােত তৈরি করার প্রস্তুতি নিতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একইভাবে ঢাকার আশপাশের জেলা নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুরের নেতাকর্মীদেরও এই সমাবেশে অংশগ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

বিএনপি সূত্রে জানা যায়, দলের নীতিনির্ধারণী নেতা এবং যুগপতে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে নানারকম কর্মসূচির প্রস্তাব এসেছে। এর মধ্যে হরতাল, অবরোধ, অসহযোগ, ঘেরাও, লংমার্চ, পদযাত্রা, অবস্থান, অনশন, মানববন্ধন। তবে বিএনপি এখনই হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে যেতে চায় না। যদিও প্রতি সপ্তাহেই এখন একটি করে বড় কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসব কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে যদি সরকারি দল, সরকারি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ কোন মাধ্যমে কোন ধরণের উস্কানি আসে তাহলে হার্ড লাইনে যাবে বিএনপি।

সেক্ষেত্রে এখন যেসব কর্মসূচির বিষয়ে ভাবা হচ্ছে না, সেসব কর্মসূচিতেও যেতে পারে দলটি। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে যেসব কর্মসূচি দিয়েছে সবগুলোতেই জনতার ঢল নেমেছে। তিনি বলেন, নিশিরাতের ভোটে ক্ষমতা দখলকারী আওয়ামী লীগ সরকারের অপশাসন ও দুঃশাসনে মানুষ আজ অতিষ্ট। তারা এক মুহূর্তও এই সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না।

এর প্রমাণ হলো বিএনপির সমাবেশে শতবাধা-প্রতিবন্ধকতা, হামলা, মামলা, গ্রেফতারের পরও পায়ে হেটে, রিক্সা-ভ্যানে করে একদিন-দুইদিন আগে এসে উপস্থিত হওয়া। বুধবারের সমাবেশেও বিএনপি নেতাকর্মী ছাড়া হাজার হাজার সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করে আওয়ামী লীগ সরকারকে লাল কার্ড দেখাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাংগঠনিক যৌথসভায় দলটির ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ১২ জুলাই থেকে নতুন পর্যায়ের আন্দোলনের ঘোষণা আসছে। ওই সমাবেশে অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে আপনাদের আসতে হবে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থাকতে হবে। সেখান থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নতুন পর্যায়ের আন্দোলনের ঘোষণা দেবেন।

তিনি বলেন, এই সরকার ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আরেকটি নির্বাচন করতে চাচ্ছে। তেমন কোনো নির্বাচন এই দেশে হবে না। জনগণ সেই নির্বাচন করতে দেবে না। সরকার পতনের দাবিতে শুধু দলের নয়, সাধারণ মানুষও মাঠে নেমে এসেছেন বলে দাবি করে বিএনপির এই নেতা বলেন, আগামী ১২ জুলাই থেকে আন্দোলনের কর্মসূচি সফল করার মাধ্যমে, নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার কায়েম করে এক দফা বাস্তবায়ন না করে ঘরে ফিরব না।

মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হক সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে নেতা-কর্মীদের ১২ জুলাইয়ের কর্মসূচিতে আসার আহ্বান জানান। নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সাত দিন কষ্ট করবেন, সারা জীবন ভালো থাকবেন। সেই প্রস্তুতি নেন।

তিনি বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে অবৈধ সরকারের পতন ঘটাব। গত ১৫ বছর অনেক কষ্ট করেছেন। এখন কিন্তু ফসল ঘরে তোলার সময়। সকল ইউনিট নিয়ে নাইটিঙ্গেল মোড়ে উপস্থিত হতে হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, কাল থেকে এক দফার চূড়ান্ত আন্দোলনের সূচনা হবে। সেখান থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এজন্য ইতোমধ্যে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অন্যান্য দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, তারা পরামর্শ দিয়েছেন, বিএনপিও তাদের পরামর্শের ভিত্তিতে যে কর্মসূচি চূড়ান্ত করেছে তা ঘোষণা করা হবে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ১২ জুলাই ঢাকায় সমাবেশ হবে। সেখানে নতুন ঘোষণা আসবে। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নতুন যাত্রা শুরু হবে।

বিএনপি বাধ্য হয়ে আন্দোলন করছে, এমন দাবি করে তিনি বলেন, আমরা তো নির্বাচন করেই এ পরিবর্তন চাই। কিন্তু নির্বাচন তো আপনি করতে দিচ্ছেন না। আওয়ামী লীগ নির্বাচন নিজে নিজে করে নিয়ে চলে যাচ্ছে, নিজেদের মতো করে। সেই ব্যবস্থা তো চলতে পারে না।

আমরা বার বার করে বলছি, আবারও বলছি, শান্তিপূর্ণভাবে বলছি, দেশটাকে বাঁচানোর জন্য এখনো সময় আছে। আপনাদের (সরকার) শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। জনগণের যে দাবি, একটা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য পদত্যাগ করে একটা নির্বাচন দিন। সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংকট দূর হবে বলে আমরা মনে করি, দেশের মানুষও বিশ্বাস করে।

জাতীয়-এর আরও খবর