রোহিঙ্গা আবদুর রহিম এখন চট্টগ্রামের বাসিন্দা

  বিশেষ প্রতিনিধি    01-06-2023    74
রোহিঙ্গা আবদুর রহিম এখন চট্টগ্রামের বাসিন্দা

অবৈধভাবে বানিয়েছেন বাংলাদেশি এনআইডি ও পাসপোর্ট * থাকেন অভিজাত এলাকায়, কিনেছেন জমি-দোকান, চলেন দামি গাড়িতে

রোহিঙ্গা মো. আবদুর রহিম এখন চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকার বাসিন্দা। অবৈধভাবে বানিয়েছেন জন্মনিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও পাসপোর্ট। তার পরিচয় গোপন করে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছেন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে।

নগরীর অভিজাত মার্কেটে কিনেছেন দোকান। সাতকানিয়া উপজেলার ছদাহা এলাকায় কিনেছেন জমি। ব্যবহার করেন দামি প্রাইভেট কার। বাসায় রয়েছে শক্তিশালী ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক। এছাড়া অন্যের এনআইডি কার্ড দিয়ে নিবন্ধন করা সিম মোবাইল ফোনে ব্যবহার করছেন তিনি।

সম্প্রতি এসএম শাহীনুর রহমান নামে সাতকানিয়া উপজেলার এক বাসিন্দা আবদুর রহিমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র সচিব (সুরক্ষা বিভাগ) ও আইজিপি বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন। এতে আবদুর রহিম আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) কমান্ডার বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) আ স ম মাহতাব উদ্দিন বুধবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, কোনো আরসা নেতা চট্টগ্রামে বসবাস করেন, এটা আমার জানা নেই।

অবৈধভাবে পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র বানানোর অভিযোগে অনেকের বিরুদ্ধে বেশকিছু মামলাও রয়েছে। ওই ব্যক্তি ওইসব মামলার আসামি কি না জানি না। আপনার কাছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির এনআইডি, ছবি থাকলে আমাদের কাছে পাঠান, আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৭ সালে যখন নির্যাতিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছিল, ওই সময় আবদুর রহিমও চলে আসেন। তিনি মিয়ানমারের মংড়ুতে বসবাস করলেও আগে থেকে চট্টগ্রামের অনেকের সঙ্গে পরিচয় ছিল। ফলে ওই সময় ক্যাম্পে না গিয়ে তিনি সোজা চলে আসেন চট্টগ্রাম নগরীতে।

বসবাস শুরু করে পাঁচলাইশ থানার সি-১, আদর ভবন, মোমিনবাগ, আমিন জুট মিল এলাকায়। ওই ভবনে দীর্ঘদিন বসবাস করার সময় ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করেন।

বর্তমানে বসবাস করছেন অভিজাত হিলভিউ আবাসিক এলাকায়। সাফা টাওয়ারের (ওরিয়েন্ট স্কুলের পাশে গলি) দশম তলায় থাকেন তিনি। ওই ভবনসংশ্লিষ্টরা জানান, আবদুর রহিম বেশির ভাগ সময় বাসায়ই অবস্থান করেন। বাসায় তার কাছে অপরিচিত ও সন্দেহজনক অনেক লোকজন আসা-যাওয়া করে।

আবদুর রহিম চট্টগ্রামে আসার পর প্রথমে সংগ্রহ করেন বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র। যার নম্বর-২৮০০২৪৩৬২৪। এতে তার বাবার নাম নূর মোহাম্মদ, মায়ের নাম রাবিয়া বেগম, জন্ম তারিখ ১ জানুয়ারি ১৯৭৮।

ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে-২৪৩, হক ম্যানশন, গ্রাম/রাস্তা-ঈদগাহ, বরফকল, রামপুর, ডাকঘর-রামপুরা টিএসও-৪২২৪, হালিশহর, ২৫ নম্বর ওয়ার্ড, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম। অথচ এ ঠিকানায় তিনি জীবনেও বসবাস করেননি। তার এনআইডির ছবি দেখালে তাকে ওই এলাকার কেউ চিনেন না বলেও জানান। ভবনটির মালিক রেহেনা আক্তার যুগান্তরকে বলেন,

আমাদের ভবনে এ ধরনের কোনো লোক বাসা ভাড়া নেননি। তাকে আমরা কোনোদিন দেখিওনি। তিনি প্রতারণামূলকভাবে আমাদের ভবনের ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। তার বিরুদ্ধে কাউন্সিলরকে আমি লিখিতভাবে অভিযোগ জানাব।

মূলত ঢাকার ইয়াবা ডন নাছির উদ্দিন নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে তিনি ৬ লাখ টাকা দিয়ে দালালের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্রটি সংগ্রহ করেন। এরপর ৩ তিন লাখ টাকা খরচ করে নিয়েছেন পাসপোর্ট। পাঁচলাইশ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে পাসপোর্টটি নেওয়া হয়। যার নম্বর-এ ০৬৬৬২০৯৯। পাসপোর্ট তৈরির নথি নম্বর ২১৩৪৪৯।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, আবদুর রহিম ও তার পরিবার দুটি মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে। এগুলো হলো-০১৮৯০-৮৬৬২৬৩ ও ০১৫৩৮-২৩৩৯০০। সিম দুটি নিবন্ধন করতে ব্যবহার করা হয়েছে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র। পরিচয়পত্রে দেখা যায়, আবুল কালাম, বাবা-আলী হোসেন, মা-ফাতেমা বেগম। ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে লক্ষ্মীপুর সদর, দত্তপাড়া-৩৭০৬।

মোহাম্মদ সাহিল নামে তার এক সন্তান পড়ালেখা করছে ওরিয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংলিশ মিডিয়ামে। কাগজপত্রে দেখা যায়, বাবার নাম আবদুর রহিম। শিক্ষাগত যোগ্যতার স্থলে লেখা রয়েছে ‘এসএসসি কমপ্লিট’। পেশা ব্যবসা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও তার আরও ৫ সন্তান পরিচয় গোপন করে চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এছাড়া তার বড় ছেলেকে অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর জন্য তোড়জোড় চলছে।

এই রোহিঙ্গা ব্যবহার করেন দামি প্রাইভেট কার। যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-ক ০৩-৮২১৬। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরটির-(বিআরটিএ) নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নিবন্ধন করা হয়েছে ঢাকার মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয় থেকে। গাড়িটির মালিক শাহেনূর আক্তার, পিতার নাম মহিউদ্দিন রানা। ইনকাম ট্যাক্স সম্পর্কে তথ্যে বলা হয়েছে, করদাতার নাম জেসমিন পারভিন। ট্যাক্স শনাক্তকরণ নম্বর ৩৩৭১০৫১৩১৮৭১ উল্লেখ করা হয়েছে। কর অঞ্চল-১৯, সার্কেল-৪০৩, জেলা-ঢাকা। অথচ গাড়িটি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করছেন আবদুর রহিম।

সাতকানিয়া পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ জোবায়ের যুগান্তরকে জানান, তার এলাকার জন্মনিবন্ধনে রোহিঙ্গা নাগরিক কীভাবে ভোটার হয়েছেন, তা খোঁজখবর নিয়ে দেখবেন তিনি।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দেশের নিরাপত্তার জন্য এরা ঝুঁকিপূর্ণ। এত সহজে অন্য দেশের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা’ দেশে বসবাস করবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানবে না, এটা হতে পারে না। তিনি বলেন, আবদুর রহিম পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র কীভাবে তৈরি করলেন, এটা একটি বড় প্রশ্ন। এ নিয়ে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসা করা উচিত

সারাদেশ-এর আরও খবর