ঈদুল আযহায় মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনে স্বদেশ ফেরার আকুতি রোহিঙ্গাদের

  বিশেষ প্রতিনিধি    30-06-2023    106
ঈদুল আযহায় মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনে স্বদেশ ফেরার আকুতি রোহিঙ্গাদের

উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে স্বদেশ ফেরার আকুতি জানিয়ে ঈদুল আযাহার নামাজ আদায় শেষে মোনাজাতের মাধ্যমে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া কামনা করেন রোহিঙ্গারা।এসময় রোহিঙ্গারা কান্নায় ভেঙে পড়েন।

নামাজ আদায়ের পর রোহিঙ্গারা একে অপরের সাথে কোলাকুলি করেন।রোহিঙ্গা কিশোর-কিশোরীদের মাঝে দেখা দিয়েছে ঈদুল আযাহার উৎসব।গরু জবাই করার পর ভাগ-বন্টন করে রান্না কাজে ব্যস্ত রোহিঙ্গা নারীরা।

বৃহস্পতিবার (২৯ জুন) সকালে উখিয়া -টেকনাফের শরণার্থী ক্যাম্পে ছোট-বড় ও মসজিদ-মত্তবে পবিত্র ঈদুল আযাহার নামাজ আদায় করেন রোহিঙ্গারা।

জানা যায়, ঈদের দিন সকাল থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কিছু অংশে বেলুন আর ঈদ মোবারক লেখা ব্যানারে গেইট দিয়ে রংবেরঙে সাজানো হয়েছে। এসব ক্যাম্পে কিশোর-কিশোরী ও শিশুরা সকাল থেকেই সেজেগুজে, নতুন জামা-কাপড় পরে ক্যাম্পের রাস্তায় হৈ-হুল্লোড় আর আনন্দে মেতে উঠেছে। অনেক যুবক ও বয়স্করাও নতুন জামা, গেঞ্জি, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি ও চশমা পরে দল বেঁধে একে অপরের সাথে কোলাকুলি করছেন, আবারো বাড়ি বাড়ি গিয়ে আত্মীয় স্বজনদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন।

শালবাগান ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা বজলুল ইসলাম বলেন,শরণার্থী জীবন কঠিন, নিজ দেশ মিয়ানমারে থাকতে আমরা গরু কোরবানি দিতে পারছি। শরণার্থী হয়ে আসার পর আমরা সেই আগের মত কোরবানি করতে পারি নাই। গত বছর কোরবানি ঈদে ২৬-২৭ নম্বর ক্যাম্পে দাতা সংস্থার পক্ষ থেকে কোরবানির সময় গরু দিলেও এবার কোন সংস্থার পক্ষ থেকে আমরা গরু বা ছাগল পাইনি।দিন দিন দাতা সংস্থার পক্ষ থেকে খাদ্য চাহিদা কমাই ফেলতেছে।আমরা আর শরণার্থী হয়ে থাকতে চাইনা, আমরা মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে নিজ দেশে ফেরত যেতে চাই।আজ আমাদের ক্যাম্পে বিশেষ মোনাজাতের মাধ্যমে সে দোয়া কামনা করা হয়।

টেকনাফ চাকমারকুল রোহিঙ্গা নেতা মো. আজিজুল হক বলেন,শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নেওয়ার পর অন্যান্য বছরের মত এবারও ক্যাম্পে শান্তিপূর্ণভাবে ঈদের নামাজ আদায় করতে পেরেছি তার জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি।ঈদের নামাজ শেষে দোয়া কামনা করা হয়।যাতে আমরা মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে যেন স্বদেশ ফেরত যেতে পারি।মিয়ানমার আমাদের নিজ দেশ হওয়ার পরও আমরা শরণার্থী শিবিরের ঈদ উদ্‌যাপন করলাম এর চাইতে কষ্টকর ও বেদনাদায়ক আর কিছু হতে পারেনা।

উখিয়ার শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা ডাক্তার জুবায়ের বলেন,আমাদের নিজ দেশ মিয়ানমার আরকান রাজ্য বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে প্রতি বছর ঈদ উদ্‌যাপন করতাম,একে -অপরের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম,নিজেরা কোরবানির গরু কিনে তা জবাই করে গরিব অসহায় সহ আত্মীয় স্বজনদের কাছে মাংস,রুটি পাঠানো হত।আজ শরণার্থী হয়ে থাকার কারণে অন্যদের সাহায্য নিয়ে আমরা কোরবানি ঈদ উদ্‌যাপন করলাম। শরণার্থী জীবন আমাদের আর ভালো লাগেনা।আমাদের ছেলে মেয়েদের মাঝে ঈদে আনন্দ দেখা দিলেও আমরা কোন রকম ভাবে দু:খ নিয়ে ঈদ উদ্‌যাপন করছি।

তিনি বিশ্ব নেতাসহ মিয়ানমার সরকারের উদ্দেশ্য করে বলেন আমাদেরকে জাতীয় পরিচয়পত্র এবং নাগরিকত্ব, নিজের বসবাসের বাড়িঘর ও জমি, সম্পত্তি ফেরত, জীবিকা ও চলাচলের অধিকার, নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দ্রুত সময়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজ দেশ মিয়ানমারের ফেরার সুযোগ দিন।এবং স্বদেশের ফেরার আকুতিতে ঈদের নামাজ শেষে বিশেষ দোয়া কামনা করা হয়।

১৬-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মোহাম্মদ জামাল পাশা বলেন,টেকনাফ শরণার্থী ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ঈদ উদযাপনে মেতে উঠেছেন।সকাল থেকে ক্যাম্পের ভেতর রোহিঙ্গা কিশোর-কিশোরী যুবক ও বয়স্করা নতুন কাপড় পরে বেড়াচ্ছেন।এবং গরু জবাই করে ভাগ-বন্টন করে যার যার ঘরে সেগুলো নিয়ে যাচ্ছে।তবে ক্যাম্পে নিরাপত্তার জোরদার করা হয়েছে।এবং গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

৮আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. ফারুক আহমেদ বলেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঈদের নামাজ সম্পন্ন হয়েছে।পাশাপাশি ক্যাম্পে যাতে কোন অপীতিকর ঘটনা না ঘটে সেখানে নজরদারি রাখা হয়েছে।

উল্লেখ্য,উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে সাড়ে ১২ লাখের বেশি অধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অবস্থান করছেন। ২০১৮ সালে আট লাখের বেশি রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারকে পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। এর মধ্যে ৭০ হাজার রোহিঙ্গাকে এ পর্যন্ত বাছাই করেছে মিয়ানমার। কিন্তু এখনো কোনো রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার সরকার ফেরত নেয়নি। পরবর্তীতে মিয়ানমার সরকারের নানা কৌশলে তারা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এড়িয়ে গেলেও বাংলাদেশ সরকারের তৎপরতা ও আন্তর্জাতিক মহলের চাপ অব্যাহত রেখেছে।

এর ফলে মিয়ানমার সরকার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার লক্ষ্যে গত ২৫ মে বাংলাদেশে আসেন মিয়ানমারের মিনিস্ট্রি অব সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্সের মংডুর আঞ্চলিক পরিচালক অং মাইউ’র নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের প্রতিনিধি দল। এর আগে গত ৫ মে বাংলাদেশ সরকার ও রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দল রাখাইন সফর করেন। এর আগে ১৫ মার্চ মিয়ানমার প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসে। সে সময় ৪৮০ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে মিয়ানমারে ফিরে যায় দলটি।

সারাদেশ-এর আরও খবর