রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করিয়ে দেওয়া দালাল চক্রকে ঠেকানো যাচ্ছে না

  বিশেষ প্রতিনিধি    09-07-2023    98
রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করিয়ে দেওয়া দালাল চক্রকে ঠেকানো যাচ্ছে না

দালাল ও অসাধু চক্রের সহায়তায় সহজেই জন্মনিবন্ধন সনদ থেকে শুরু করে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), এমনকি পাসপোর্টও পেয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। যদিও পাসপোর্ট অধিদফতর বলছে, আবেদনকারীর এনআইডি, জন্মনিবন্ধন সনদ এবং বর্তমান ঠিকানা যাচাই-বাছাইয়ের পরই কেবল পাসপোর্ট হাতে পান আবেদনকারী। এক্ষেত্রে ভেরিফিকেশনের কাজটি করেন স্পেশাল ব্রাঞ্চের কর্মকর্তারা। তারা যদি ঠিকানা এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে সত্যতা পান এবং এরপর পুলিশের অনুমোদন মেলে তখন আবেদনকারী পাসপোর্ট পেয়ে থাকেন। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দালাল চক্র এতটাই চতুর ও সংগঠিত যে তাদের এ অবৈধ কর্মকাণ্ড কোনোভাবে ঠেকানো যাচ্ছে না।

চলতি বছরের জুন মাসের মাঝামাঝি পাসপোর্ট করতে এসে কর্মকর্তাদের সন্দেহের জালে আটকা পড়েন দুই রোহিঙ্গা। এ ঘটনা রাজধানীর উত্তরায় আঞ্চলিক পাসপোর্ট কেন্দ্রের। ভাষাগত কারণে পাসপোর্ট অধিদফতর কর্মকর্তাদের সন্দেহ হলে তথ্য যাচাই-বাছাই করে তারা দেখতে পান— আবেদনকারীদের ঠিকানা নরসিংদীর, কিন্তু তিনি কথা বলছেন চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের আঞ্চলিক ভাষায়। পরে পুলিশে খবর দিলে দুই রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। গ্রেফতারকৃত রোহিঙ্গারা পুলিশকে জানান, এক দালালের মাধ্যমে তারা পাসপোর্ট করতে এসেছেন। সেই দালালের সহায়তায় জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) এবং জন্মনিবন্ধনও করেন তারা।

পাসপোর্ট অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে এনআইডি এবং জন্মনিবন্ধনসহ আবেদনকারীর ঠিকানা যাচাই-বাছাই করা হয়। পাসপোর্ট নবায়ন করতে গেলে কোনও কিছু পরিবর্তন না থাকলে, সেখানে আর নতুন করে ভেরিফিকেশন প্রয়োজন হয় না। এনআইডির জন্য নির্বাচন কমিশনের সার্ভার ও জন্মনিবন্ধনের সার্ভার থেকে সহায়তা পেয়ে থাকে পাসপোর্ট অধিদফতর। তবে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের যে প্রকল্প রয়েছে, সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের ফিঙ্গার প্রিন্টসহ তথ্য জানার কোনও সুযোগ নেই পাসপোর্ট অধিদফতরের। যে কারণে অর্থের বিনিময়ে অবৈধভাবে এনআইডি ও জন্মসনদ ম্যানেজ করে সহজেই পাসপোর্ট পেয়ে যান রোহিঙ্গারা।

পাসপোর্ট অধিদফতরের পরিচালক (ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাসপোর্ট করতে যেকোনও নাগরিকের বৈধ এনআইডি বা জন্মনিবন্ধন লাগে। এরপর ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে পজিটিভ রিপোর্ট পেলে পাসপোর্ট দেওয়া হয়। যে কেউ দেশের যেকোনও জায়গায় পাসপোর্ট করতে এলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আবেদনকারীর সঙ্গে কথা বলেন, বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। এছাড়া, অধিদফতরের কোনও কর্মকর্তা বা অসাধু চক্রের তৎপরতা ঠেকাতে নিয়মিত মনিটরিং জোরদার রয়েছে।’

পুলিশ বলছে, রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গায় রোহিঙ্গাদের কাছে পাসপোর্ট, এনআইডি, জন্মনিবন্ধন পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন অসাধু চক্র তৎপর রয়েছে। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য এনআইডি তৈরি করে দেয়, এরপর তাদের পাসপোর্ট তৈরিতেও সহায়তা করে এই চক্রের সদস্যরা। এ কাজে তারা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। বিভিন্ন সময় অসাধু চক্রের সদস্যরা পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও তাদের তৎপরতা ঠেকানো যাচ্ছে না।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, দালাল চক্রগুলো এতটাই সক্রিয় যে যেসব জায়গার ঠিকানা তারা ব্যবহার করে, সেসব জায়গায় তাদের চক্রের সদস্যরা অবস্থান করে। পুলিশ বা গোয়েন্দারা ওই ঠিকানায় ভেরিফিকেশনে গেলে আবেদনকারীকে তাদের আত্মীয় পরিচয় দেয় এবং প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র সঠিকভাবেই উপস্থাপন করে। ভেরিফিকেশনে যাওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের যদি মনে হয়, কোনও ধরনের সমস্যা আছে, তাহলে তিনি বিষয়টি তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট করেন।

গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ভুয়া এনআইডি বানিয়ে রোহিঙ্গাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সারা দেশে বেশ কিছু চক্র সক্রিয় রয়েছে। তারা পাসপোর্টও বানিয়ে দেয়। এ কাজে পাসপোর্ট অধিদফতরের কিছু লোকও জড়িত আছে। এই চক্রকে কোনোভাবে রোধ করা যাচ্ছে না।

ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সম্প্রতি বিভিন্ন অভিযানে আমরা দেখতে পেয়েছি— দালাল চক্র রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট করিয়ে দেওয়ার জন্য লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। পাসপোর্টের আবেদন করার সময় ভুয়া নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে আমাদের নজরদারি চলমান রয়েছে।’

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাসপোর্ট, এনআইডি ও জন্মনিবন্ধন জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত এবং তা রোহিঙ্গাদের কাছে সরবরাহ করার অভিযোগে এরইমধ্যে বেশ কয়েকজনকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন চক্রকে শনাক্তের কাজ চলছে। পাসপোর্ট অফিসের কোনও কোনও স্টাফের বিরুদ্ধেও এ সংক্রান্ত তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে। সেসব পর্যালোচনা করা হচ্ছে।’

সারাদেশ-এর আরও খবর