হাইওয়ে পুলিশের টোকেন বাণিজ্য

  বিশেষ প্রতিনিধি    08-06-2023    74
হাইওয়ে পুলিশের টোকেন বাণিজ্য

কক্সবাজারের টেকনাফে মাসিক ‘টোকেন’ দিয়ে বিভিন্ন যানবাহন থেকে চাঁদা আদায় করছে হাইওয়ে পুলিশ। এর ফলে বৈধ যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অবৈধ সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের মতো তিন চাকার যান। টোকেন থাকায় অবৈধ ইজিবাইক, মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশা, পিকআপ ও লবণের ট্রাকের চালকদের লাইসেন্সের দরকার হয় না। দেখাতে হয় না গাড়ির কাগজপত্র। কখনও কোনও কারণে এসব যান আটক করা হলে টোকেন দেখালেই ছেড়ে দেওয়া হয়।

এ ছাড়া গভীর রাতে মাদক তল্লাশির নামে স্থলবন্দরের গাড়ি থেকে শুরু করে দূরপাল্লার যানবাহন থামিয়ে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। নেওয়া হয় চাঁদা। অথচ এসব কাজে তল্লাশির জন্য সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে রয়েছে বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চেকপোস্ট। এরপরও তল্লাশির নামে হয়রানি ও চাঁদা আদায় করছে হাইওয়ে পুলিশ।

সরেজমিনে কয়েকটি এলাকা ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজার-টেকনাফ আঞ্চলিক সড়কের পাশে একদিকে রোহিঙ্গা বাজার অপরদিকে রোহিঙ্গাদের মালিকানাধীন শত শত ইজিবাইক। এসব এখন স্থানীয়দের জন্য সড়কে যাতায়াতে বিষফোঁড়া। সড়কের ওপরে প্রতিনিয়ত ট্রাকে লবণভর্তি করা হয়। ট্রাকে লবণভর্তির সময় সড়কে প্রচুর পরিমাণ লবণের পানি পড়ে। এতে ভোগান্তির সৃষ্টি হয়। অথচ সড়কে লবণভর্তির কথা ছিল না।

আবার মিনি ট্রাকগুলো পাহাড়ি ও ফসলি মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ার সময় সড়কে কিছু মাটি ফেলে যায়। এতে লবণের পানি ও মাটি একাকার হয়ে পুরো সড়ক পিচ্ছিল হয়ে যায়। ফলে প্রতিনিয়ত মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক, সিএনজি অটোরিকশাসহ অনেক গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। অথচ টেকনাফ হাইওয়ে পুলিশ এসব দেখেও যেন দেখে না।

কয়েকটি গাড়ির মালিক ও কয়েকজন শ্রমিকনেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হোয়াইক্যং হাইওয়ে পুলিশ এখন টোকেন বাণিজ্য ও দৈনিক উপার্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিটি লবণের গাড়ি থেকে ৫০০ থেকে এক হাজার করে চাঁদা নেয়। প্রতিটি ডাম্পার (মিনি ট্রাক) থেকে মাসিক এক হাজার টাকা করে চাঁদা নেয়। টাকা নিয়ে গাড়ির মালিক কিংবা চালকের হাতে ধরিয়ে দেয় এক মাস মেয়াদি টোকেন। এই টোকেন বাণিজ্য করে মাসে একেক যান থেকে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা নিচ্ছে হাইওয়ে পুলিশ।

পরিবহন চালক-মালিক এবং স্থানীয়দের অভিযোগ, হোয়াইক্যং হাইওয়ে পুলিশের ওসি কাইয়ুম উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে পুলিশের কিছু সদস্য ও স্থানীয় কয়েকজন পরিবহন নেতা মিলে সিন্ডিকেট করে চালাচ্ছেন টোকেন বাণিজ্য। শ্রমিক সংগঠনের সিল ব্যবহার করে টোকেনের মাধ্যমে এসব টাকা আদায় করা হয়। চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে কয়েকজন রোহিঙ্গা এখন একাধিক টমটম ও সিএনজি অটোরিকশার মালিক।

আবার এসব টমটম ও অটোরিকশার চালক রোহিঙ্গা যুবক-কিশোর। এ কারণে প্রায় ঘটছে দুর্ঘটনা। অনেক চালকের বয়স ১৮ বছরের নিচে। আইনের তোয়াক্কা করছে না তারা। এসব চালকের নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স, নেই গাড়ির কাগজপত্র। নেই কোন ধরনের প্রশিক্ষণ। রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকার বাইরে আসার অনুমতি না থাকলেও এসব চালক টমটম ও অটোরিকশা সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক চালক ও শ্রমিক জানিয়েছেন, রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে এসে গাড়ি চালালেও নজরে পড়ে না হাইওয়ে পুলিশের। জবাবদিহির বাইরে গিয়ে দায়সারা দায়িত্বপালন করে সময় পার করছে হোয়াইক্যং হাইওয়ে পুলিশ। বর্তমানে এই সড়কে অনিয়ম যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, মাসিক টোকেনের চাঁদা না দিলে রাস্তায় নেমে পড়েন হাইওয়ে পুলিশের একাধিক সদস্য। তারা ব্যাটারিচালিত টমটম ও অটোরিকশা আটক করে চাঁদা নেন। মোটরবাইক ও পিকআপভ্যান থেকেও টোকেন বাণিজ্য করেন। নির্ধারিত টাকা পাওয়ার পর চালকদের হাতে তুলে দেওয়া হয় টোকেন। এই টোকেন নিয়ে চলছে টমটম, ইজিবাইক, সিএনজি অটোরিকশা ও ডাম্পার। টাকা তোলার দায়িত্বে রয়েছেন সেক্টরভিত্তিক একাধিক লোক। আটকে রাখা টমটম ছাড়ার ফি নেওয়া হয় কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা। ক্ষেত্রবিশেষে নেওয়া হয় ১২-১৫ হাজার টাকা। বিশেষ তদবির থাকলে ফি সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা।

পুলিশের হয়রানির ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ১০-১৫ জন চালক ও মালিক বলেন, আর সহ্য করতে পারছি না। সিএনজি, টমটম আটকের পরই কতিপয় দালাল ভয়ভীতি দেখাতে থাকে। দালালিতে রয়েছে পরিবহন শ্রমিকনেতারাও। অনেক সময় দালাল ছাড়া পুলিশের সঙ্গে কথাও বলা যায় না। কেউ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলে মামলা দেওয়ার হুমকি আসে। হোয়াইক্যংয়ে ট্রাক, টমটম, পিকআপভ্যান ও অটোরিকশা থেকে চাঁদা তোলার দায়িত্বে রয়েছেন একাধিক ব্যক্তি।

চালক, মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হোয়াইক্যং হাইওয়ে পুলিশ এখন ঘুষ বাণিজ্যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বিধি না থাকলেও সড়কের পাশে রয়েছে একাধিক স্ট্যান্ড। এসব স্ট্যান্ড থেকে শ্রমিকনেতাদের মাধ্যমে মাসিক মোটা অঙ্কের মাসোয়ারা যাচ্ছে পুলিশের পকেটে। হোয়াইক্যং বিজিবি চেকপোস্টের পর থেকে দিনেরাতে তাদের টার্গেট সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত টমটম ও পণ্যবোঝাই ট্রাক। টোকেন না থাকলেই দেওয়া হয় মামলা।

মামলাগুলো হচ্ছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সামাল দেওয়ার একটা অস্ত্র। আটকের পর দর-কষাকষিতে জড়িয়ে পড়ে পুলিশের কয়েকজন প্রতিনিধি। তারা প্রথমে চালক কিংবা মালিকের সঙ্গে ছাড়ের মূল্য নির্ধারণে কাজ শুরু করেন। নিজের কমিশনসহ হিসাব মিললে গাড়ি ছাড়ের ব্যবস্থা করে দেন। হিসাব না মিললে ঘোরাতে থাকেন দিনের পর দিন। হোয়াইক্যংয়ের আশপাশের বিভিন্ন স্ট্যান্ডের লোকজনের সঙ্গে রয়েছে দালাল ও পুলিশের গোপন মাসিক চুক্তি। ১৫-২০টি গাড়ির টাকা মাসে একবার দালাল অথবা পুলিশের চিহ্নিত লোকের কাছে জমা দেওয়া হয়।

টেকনাফ সড়কে চলাচলকারী নিবন্ধনহীন গাড়ির সংখ্যা হাজারের বেশি। তবে আটকের ক্ষেত্রে কোনও ছাড় নেই বলে জানালেন চালকরা। পরে হাইওয়ে পুলিশকে চাঁদা দিয়ে গাড়ি ছাড়াতে হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক শ্রমিকনেতা বলেন, ‘হাইওয়ে পুলিশের মাসোয়ারা এখন অনেক বেশি। হাইওয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করবো, নাকি চালক-শ্রমিকদের পেটের খবর রাখবো- ভেবে পাই না। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই।’

টোকেন বাণিজ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফ হোয়াইক্যং হাইওয়ে পুলিশের ওসি কাইয়ুম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘টোকেন ব্যবসা একসময় ছিল। তবে এখন নেই। হোয়াইক্যং হাইওয়ে পুলিশ কোনও যানবাহন থেকে টাকা নেয় না। যদি কোনও হাইওয়ে পুলিশ সদস্য অবৈধভাবে টাকা নেয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

সারাদেশ-এর আরও খবর