১৮০ রোহিঙ্গার নিখোঁজ রহস্য উদ্‌ঘাটন করল এপি

  বিশেষ প্রতিনিধি    08-06-2023    88
১৮০ রোহিঙ্গার নিখোঁজ রহস্য উদ্‌ঘাটন করল এপি

কক্সবাজার উপকূল থেকে ১৮০ রোহিঙ্গাকে নিয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে একটি ট্রলার মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলটির কেউই মালয়েশিয়ায় পৌঁছাতে পারেনি। পুরো দলটিই নিখোঁজ হয়ে যায়।

এবার একটি ফোনকলের সূত্র ধরে নিখোঁজ সেই দলটির সর্বশেষ পরিণতি সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা এপি।

নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ওই নৌকা থেকে গত বছরের ৭ ডিসেম্বর রাত ১১টায় কলটি করেছিলেন সেতারা বেগম নামে এক রোহিঙ্গা নারী। আর মালয়েশিয়া থেকে কলটি রিসিভ করেছিলেন সেতারার স্বামী মোহম্মদ রশিদ।

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১২ সালে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে কক্সবাজারের নয়াপাড়া ক্যাম্পে এসে বসবাস করছিলেন সেতারা। তাঁর স্বামী রশিদ অবশ্য সে বছরই মালয়েশিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিলেন।

নয়াপাড়া ক্যাম্পের এইচ ব্লকে সেতারা যে ঘরটিতে থাকতেন তার কয়েক ঘর পরেই বসবাস করতেন জামাল হোসেইন নামে আরেক রোহিঙ্গা। মিয়ানমারে অবস্থাপন্ন কৃষক ছিলেন জামাল। পরে বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে এলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তাঁর জীবন অনেক কঠিন হয়ে যায়। মৃত্যুর হুমকিও পেয়েছিলেন একাধিকবার।

এ অবস্থায় মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি কাঠের নৌকা কিনেছিলেন জামাল। ওই নৌকায় নিজের পরিবারের ১৬ সদস্যসহ বড় একটি রোহিঙ্গা দলকে নিয়ে সমুদ্রপথে ইন্দোনেশিয়া হয়ে মালয়েশিয়ায় যাওয়াই ছিল তার লক্ষ্য।

প্রতিবেশী জামালের ওই নৌকাতেই ১৮ ও ১৫ বছর বয়সী দুই মেয়েকে নিয়ে চড়ে বসেছিলেন সেতারা। তিন মেয়ের মধ্যে বড় জনকে তিনি আগেই বিয়ে দিয়েছিলেন। স্বামীর অনুপস্থিতিতে তিন মেয়েকে অনেক সংগ্রাম করে বড় করেছিলেন সেতারা। স্বামী রশিদ মালয়েশিয়ায় একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করে মাঝে মাঝে খরচ পাঠালেও তা অপরাধ চক্রের নজরে পড়ে গিয়েছিল। সেতারার এক ভাইপোকে তাই অপহরণ করে তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করে তারা।

এ অবস্থায় গত বছর নভেম্বরের শেষ দিকে সেতারা তাঁর বাবার কাছে মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার অনুমতি চান। বাবা নিষেধ করলেও সেতারা তাঁর সিদ্ধান্তেই অটল থাকেন।

১ ডিসেম্বর রোহিঙ্গা দলটি জামালের নৌকায় চড়ে বসে। শেষ মুহূর্তে সেতারা তার স্বামী রশিদকে ফোন করে প্রথমবারের মতো জানান যে গয়না বিক্রি করে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে দুই মেয়েকে নিয়ে তিনি মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা হচ্ছেন।

এ সময় রশিদ বারবার নিষেধ করলেও সেতারা শোনেননি। স্ত্রী আর দুই কন্যার সমূহ বিপদের কথা চিন্তা করে কেঁদে ফেলেছিলেন রশিদ।

ওই নৌকা থেকেই এক সপ্তাহ পর রশিদকে শেষবারের মতো কলটি করেছিলেন সেতারা। ৪৪ সেকেন্ড স্থায়ী ওই ফোনকলটির শুরুতেই সেতারা আর্তনাদ করে বলছিলেন-‘ও আল্লাহ! আমাদের নৌকাটা ডুবে গেছে! নৌকাটার অর্ধেকটা শুধু ভেসে আছে। আমাদের জন্য দোয়া কোরো, বাবা-মাকে খবরটা দিও।’

এ অবস্থায় ভীতসন্ত্রস্ত গলায় রশিদ তাঁদের অবস্থান জানতে চাইলেও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি সেতারা।

সেতারার শেষ কথাটি ছিল-‘ও আল্লাহ! নৌকাটা ঢেউয়ে ডুবে গেল! ঝড়ে ডুবে গেল!’

এরপরই কলটির লাইন কেটে যায়। রশিদ সঙ্গে সঙ্গেই কলব্যাক করেন। কিন্তু রিং বাজলেও কেউ আর এটি ধরেনি। এভাবে টানা কয়েক শ বার কল করেন রশিদ। কিন্তু কেউ ধরেনি। একসময় ফোনের সংযোগই বিচ্ছিন্ন দেখায়।

ফোনকলটির সূত্র ধরে বিষয়টির অনুসন্ধান করতে গিয়ে আরেকটি নৌকার সন্ধান পায় অ্যাসোসিয়েট প্রেস (এপি)। ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছাতে পারা ওই নৌকাটির মাঝি ছিলেন কেফায়াত উল্লাহ নামে আরেক রোহিঙ্গা।

কেফায়াতের দেওয়া তথ্যমতে, যাত্রা শুরুর তিন দিনের মধ্যেই জামালের নৌকাটির সঙ্গে মাঝ সমুদ্রে তাঁর দেখা হয়েছিল। ইঞ্জিনে সমস্যা হওয়ায় জামালের নৌকাটি এ সময় থেমে গিয়েছিল।

পরে কেফায়াতের সহযোগিতা নিয়ে নৌকাটির ইঞ্জিন আবার চালু করে যাত্রা শুরু করেন জামাল। কেফায়াতের নৌকাটি তার পেছন পেছন যাচ্ছিল। এভাবে চার দিন যাওয়ার পরই হঠাৎ ফুঁসে ওঠে সমুদ্র। শুরু হয় তীব্র ঝড়, সঙ্গে বৃষ্টি আর বড় বড় ঢেউ। নৌকায় থাকা যাত্রী আর মালামালের সুরক্ষা দিতে কেফায়াত এ সময় প্রাণপণ লড়াই শুরু করেন।

রাতের আঁধারে ঝড়ের মধ্যেই কেফায়াত দেখছিলেন তাঁর নৌকা থেকেই খানিক দূরে অবস্থান করা জামালের নৌকাটিতে একটি আলোর বিন্দু জ্বলছে। কিন্তু একসময় সেই আলোটি নিভে গেল!

সারাদেশ-এর আরও খবর